সংবাদদাতা- সরকার হটানোর এক দফা আন্দোলনকে চূড়ান্ত রূপ দিতে চায় বিএনপি। তবে এ ‘চূড়ান্ত’ আন্দোলন নিয়ে এখনো কোনো স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেনি দলটির নীতিনির্ধারকেরা।
গত এক বছর ধরে বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনসহ ১০ দফা দাবিতে রাজপথে রয়েছে। যুগপৎ আন্দোলনে কর্মসূচি নিয়ে মাঠে রয়েছে বিএনপির সমমনা দলগুলোও।
বিএনপির শীর্ষ নেতারা বলে আসছেন এক দফা নিয়ে শিগগির চূড়ান্ত আন্দোলন। কবে সেই আন্দোলন শুরু হবে সেই প্রশ্ন উঠেছে খোদ দলের মধ্যেই। তাদের প্রশ্ন, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে চলমান আন্দোলন এভাবে আর কত দিন চলবে বা চূড়ান্ত আন্দোলনের মোক্ষম সময়টি কখন?
এ বিষয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘জনগণই নির্ধারণ করবে বিএনপি কোন সময়ে কোন ধরনের আন্দোলনে যাবে। আমাদের দেশে আগে থেকেই আন্দোলন বলতেই হরতাল অবরোধ এ সমস্তকে বোঝে মানুষ।’
‘আমরা এ কর্মসূচিগুলো কিন্তু অত্যন্ত সচেতনভাবেই পরিহার করছি। আমরা নিয়মতান্ত্রিকভাবে, শান্তিপূর্ণভাবেই জনগণকে সঙ্গে নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে চাই’—যোগ করেন বিএনপি মহাসচিব।
বিএনপির চূড়ান্ত আন্দোলন নিয়ে জানতে চাওয়া হয়েছিল দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনের কাছে। সম্প্রতি অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার আগে তিনি বলেন, ‘আমাদের সঙ্গে যারা চলমান যুগপৎ আন্দোলনে শরিক আছেন তাদেরকে নিয়েই আমরা যৌথ ঘোষণার মাধ্যমে চূড়ান্ত আন্দোলন কর্মসূচি ঘোষণা করবো।’
ঘোষণা কবে নাগাদ হতে পারে প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘জনগণের দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। এখন এর কোনো বিকল্প নেই।’
২০১৪ সালের পর রাজপথে কঠোর আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি বিএনপি। দলটির কয়েকজন নেতার সঙ্গে আলাপে বোঝা গেছে, এবার চূড়ান্ত আন্দোলনের প্রস্তুতি হিসেবেই যুগপৎ আন্দোলন কর্মসূচিতে গেছে বিএনপি।
রাজপথের দীর্ঘদিনের সঙ্গী ২০ দলের বাইরেও সম্পৃক্ত করা হয় সমমনা আরও কয়েকটি দলকে। যদিও গেল বছরের শেষ দিকে বিশ দলীয় জোট বিলুপ্ত ঘোষণা করে বিএনপি।
তবে যুগপৎ আন্দোলনের ডাক দিলেও মাঠের রাজনীতিতে সেটি সেই অর্থে জমাতে পারেনি বিএনপি। যদিও ২০২২ সালের শেষের দিকে বিএনপির ঢাকা বিভাগীয় সমাবেশকে কেন্দ্র করে হঠাৎ করেই উত্তপ্ত হয়ে ওঠে রাজপথ। তবে সেটিও পরবর্তীতে ঝিমিয়ে পড়ে।
গত বছর ৮ অক্টোবর চট্টগ্রামে, ১৫ অক্টোবর ময়মনসিংহে, ২২ অক্টোবর খুলনায়, ২৯ অক্টোবর রংপুরে, ৫ নভেম্বর বরিশালে, ১২ নভেম্বর ফরিদপুরে, ১৯ নভেম্বর সিলেটে, ২৬ নভেম্বর কুমিল্লায়, ৩ ডিসেম্বর রাজশাহীতে এবং ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় সফল গণসমাবেশ করে বিএনপি।
আর গেল ১০ ডিসেম্বর সরকার পতনসহ ১০ দফা কর্মসূচি বাস্তবায়নে চূড়ান্ত আন্দোলন কর্মসূচি ঘোষণা করার কথা থাকলেও তা আর করেনি বিএনপি। এছাড়া চলতি বছরের শুরুতে চূড়ান্ত আন্দোলনের লক্ষ্য নিয়ে দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান গেল বছরে ভার্চুয়ালি তৃণমূল নেতাদের নিয়ে ম্যারাথন সভা করেছিলেন।
বিএনপির চূড়ান্ত আন্দোলন নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের একাধিক নেতা টিপ্পনী করে বলেছেন, বিএনপির চূড়ান্ত আন্দোলন ঈদের পরে, সেটা কোন ঈদ? বিএনপির চূড়ান্ত আন্দোলনে যাওয়ার আদৌ কোনো ক্ষমতা নেই বলেও মন্তব্য করেছেন কেউ কেউ।
এ বিষয়ে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, ‘সরকারের বিরোধী দলের বিরুদ্ধে বিদ্রূপ বা উপহাস করা ছাড়া আর কোনো কাজ নেই। তবে আমরা সরকারের উস্কানি বা ফাঁদে পা দিবো না।’
‘তাছাড়া বিএনপি কখনো চূড়ান্ত আন্দোলন নিয়ে দিনক্ষণ ঘোষণা করেনি। যেদিন মানুষ তার অধিকার ফিরে পাবে, সরকারের পতন ঘটবে সেদিনই আমরা মনে করবো চূড়ান্ত আন্দোলন সফল হয়েছে।’
তবে বিএনপির দায়িত্বশীল নেতারা বলছেন, তাদের আন্দোলন চলমান রয়েছে। যেকোনো সময়ে যেকোনো ধরনের কর্মসূচি আসতে পারে। এটা সরকারের আচরণের ওপর নির্ভর করছে।
জাতীয় নির্বাচন আর বাকি মাত্র ছয় মাস। এই সময়ের মধ্যে আন্দোলনের মোক্ষম সময় হলেও পরিস্থিতি তৈরির ক্ষেত্রে বাধা হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে বর্ষার মৌসুম, পবিত্র ঈদুল আজহা এবং আগস্ট মাসে এইচএসসি পরীক্ষা ও শোকের মাস।
এইচএসসি পরীক্ষা ছাড়াও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাহাদাতের মাস আগস্টজুড়ে থাকবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের শোকের কর্মসূচি। এই সময়টাকে অর্থাৎ আগস্ট মাসকে এড়াতে চায় বিএনপি। এরপর সময় থাকে সেপ্টেম্বর-অক্টোবর—মাত্র দুই মাস। হিসাব অনুযায়ী, নভেম্বরেই তফসিল ঘোষণা করতে হয়।
বিএনপির একাধিক সূত্র বলছে, ঈদের পরে জুলাই মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে বিএনপি কঠোর কর্মসূচির দিকে যাওয়ার ছক তৈরি করেছে। তারুণ্যের সমাবেশে ব্যাপক সমাগম ঘটানোর পরিকল্পনা বিএনপি ও তার অঙ্গসংগঠনের।
এই সমাবেশে কমবেশি বাধা আসতে পারে। ২২ জুলাই ঢাকার সমাবেশে যদি সরকার কঠোর অবস্থানে থেকে বাধা দেয়ার চেষ্টা করে তবে ওই সমাবেশকে কেন্দ্র করে বিএনপি একদফার কঠোর কর্মসূচিতে যাবে।
বিএনপি নেতাকর্মীরা মনে করছেন, জুলাই মাসের মধ্যে সরকারের ওপর জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক চাপ আরও বৃদ্ধি পাবে। বিশেষ করে বাজেটের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া জনগণের মধ্যে তৈরি হবে। মার্কিন তথা পশ্চিমারা বাংলাদেশ ইস্যুতে আরও পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে।
এছাড়া বিএনপিও এখন জোর কূটনৈতিক তৎপরতা চালাচ্ছে। বিএনপির প্রতিনিধি দল প্রতিদিন কোনো না কোনো দেশের কূটনীতিকের সঙ্গে বৈঠক করছেন। বিশেষ করে মার্কিনসহ পশ্চিমা দেশের কূটনীতিকের সঙ্গে বৈঠক এখন বিএনপির যেন রুটিন ওয়ার্ক। আগামীতে এই তৎপরতা আরও বাড়াবে বিএনপি। এসব পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে চূড়ান্ত কর্মসূচি ঘোষণা করবে দলটি।
চূড়ান্ত কর্মসূচিতে যা থাকতে পারে:
বিএনপির এক দফার আন্দোলন কর্মসূচিতে কী থাকতে পারে তা নিয়েও ভাবনা আছে নেতাকর্মীদের। তারা বলছেন, বিএনপি শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির দিকে থাকতে চায়। সেক্ষেত্রে তারা ‘অবরোধ, অবস্থান ধর্মঘট ও ঘেরাওয়ের’ মতো কর্মসূচিকে বেছে নিতে চান। এক্ষেত্রে সড়ক ও রেলপথ, পানিপথ অবরোধের মতো সিদ্ধান্তে যেতে পারে।
এছাড়া সরকারি অফিস যেমন উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয়, স্থানীয় নির্বাচন অফিস, থানা, জেলা প্রশাসকের অফিস, এসপি অফিস ঘেরাওয়ের কর্মসূচি দেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।
ঢাকায় সচিবালয়, নির্বাচন কমিশন, গণভবন, বঙ্গভবন ঘেরাও কর্মসূচি আসতে পারে। এছাড়া জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার সামনে লাগাতার অবস্থান ধর্মঘটের কর্মসূচি দেয়ার পক্ষে সিদ্ধান্ত হয়েছে। অতীতের ব্যর্থতা থেকে দলটি এবার ঢাকাকে আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু করতে চায়।
হরতালের মতো কর্মসূচি বিএনপি এড়িয়ে চলছে। এ ধরনের কর্মসূচিতে সরকার নানা কায়দায় সহিংসতার পথ তৈরি করতে পারে। যার দায়ভার বিএনপির ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়ার শঙ্কা রয়েছে দলটির। ২০১৩-১৪ সালের আন্দোলনের সময় বিএনপি এমন পরিস্থিতির শিকার হয়েছে বলে মনে করছে দলের নেতাকর্মীরা।
এদিকে কর্মসূচিতে শরিকদের সর্বোচ্চ সমর্থন নিয়ে মাঠে থাকার নির্দেশনা দিয়েছে বিএনপি। কর্মসূচি পালনে একই সময়ে বিভিন্ন স্থানে জড়ো না হয়ে ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় অবস্থান নেয়ার ব্যাপারেও শরিকদের সঙ্গে বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। এখন থেকে শরিকদের মাঠে শক্তভাবে নামতেও নির্দেশনা রয়েছে বিএনপির।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু এ বিষয়ে বলেন, ‘সরকার যেদিন পদত্যাগ করবে সেদিনই চূড়ান্ত আন্দোলনের সমাপ্তি ঘটবে। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলন ছয় মাসে আমাদের ১৭ নেতাকর্মী শহীদ হয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালেও ১৭ জন নিহত হয়েছে কি না খোঁজ নিয়ে দেখা যেতে পারে।’
শামসুজ্জামান দুদু আরও বলেন, ‘গত ১৭ বছরে এ স্বৈরাচার শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যে আন্দোলন হয়েছে যা পাকিস্তান শাসনামলের ২৪ বছরেও হয়নি। জনতার আন্দোলন নিয়ে একমাত্র স্বৈরাচার বা কর্তৃত্ববাদী শাসকরাই উপহাস করতে পারে। আর গণতান্ত্রিক আন্দোলনে যারা থাকে তারা এ নিয়ে গৌরব বোধ করে।’

